৫১৫ বছরে পড়ল জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর রাজস্টেট এর দুর্গাপূজো

উত্তরবঙ্গ কলকাতা দক্ষিণবঙ্গ দেশ প্রথম পাতা বিদেশ বিনোদন রবিবার রাজ্য শরীর ও স্বাস্থ্য

জলপাইগুড়ি:-

কনকদুর্গা রুপে উমা’র আরাধনা। ৫১৫ বছরে পড়ল জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর রাজস্টেট এর দুর্গাপূজো । বর্তমানে রাজবাড়ির অন্দরে পূজোর আয়োজনে ব্যাস্ততা তুঙ্গে।
জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর রাজ এস্টেট, যা জলপাইগুড়ি রাজবাড়ি নামেই বেশি পরিচিত। ৫১৫ বছরের পুরোনো এই পূজো ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে নানান গল্পকথা।
সেই গল্পকথার সূত্র ধরে জানা যায়, শিশু সিংহ এবং বিশু সিংহ নামে দুই সহদোর এই রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা । তারা বীর যোদ্ধা ছিলেন। ১৫০৯ সালে রাজা শিশু সিংহের হাত ধরেই রাজবাড়িতে দুর্গাপূজোর প্রচলন। তারপর থেকে ধারাবাহিক ভাবেই এই পুজো হয়ে আসছে। তবে এখন যেমন রাজা নেই, তেমনি নেই রাজত্বও, নেই সেই সময়কার জাঁকজমকও। তবে জাঁকজমক কমলেও ভাঁটা পড়েনি নিয়মনিষ্ঠায়। এখনো জলপাইগুড়ি রাজবাড়ির দূর্গাপূজো সেই প্রাচীনকালের নিয়মনিষ্ঠা মেনেই হয় এখনো। এই পূজো আজও বহন করে চলেছে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যও।
রাজপরিবারের বংশ পরম্পরায় পূজো করে আসছেন কুলপুরোহিত শিবু ঘোষালের পরিবাত। পুরোহিত শিবু ঘোষালই এখন রাজবাড়ি এবং নাটমন্দিরে দেখভাল করেন সারা বছর। তার কাছ থেকে জানা গেলো এই দূর্গাপজো ঘিরে অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনী।

সেই প্রায় পাঁচ শতাব্দী আগের রীতি মেনেই এখনও মা দুর্গতিনাশিনীর পুজো হয় এখানে।
কনকদূর্গা রুপে তৈরী হয় রাজবাড়ির মায়ের প্রতিমা। দীর্ঘদিন ধরে রাজবাড়ির এই দূর্গা প্রতিমা তৈরী করে আসছেন মৃৎশিল্পী সুভাষ পাল ও তার সহশিল্পীরা।
মায়ের প্রতিমা হয় তপ্ত-কাঞ্চন বর্ণের। ভারতবর্ষের বিভিন্ন পূন্যভূমি থেকে মাটি জোগাড় করে আনা হয়। সেই মাটি দিয়েই প্রতিমা তৈরী করেন মৃৎশিল্পীরা। চাকা দেওয়া রথের ওপর “একচালা দূর্গা পরিবার” নির্মিত হয় মৃৎশিল্পীদের হাতের নিপূন দক্ষতায়। মায়ের প্রতিমার উচ্চতা ১৫ ফিট। কনকদুর্গার বাহন দুটি। একটি পাখাওয়াল সিংহ, আরেকটি হল বাঘ। একচালা রথের ওপর থাকে পুরো ‘দুর্গা পরিবার’। স্বামী মহেশ্বরের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে ব্রহ্মা আর বিষ্ণু। চারপাশে উপবিষ্ট কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী। মায়ের পাশে স্থান পেয়েছে দেবাদিদেবের চেলা নন্দীর স্ত্রী জয়া ও তার সখী বিজয়া। রয়েছে মহিষাসুর এবং তার মহিষও। মৃৎশিল্পী সুভাষ পাল এবং তার সহশিল্পী বাপী পাল কথায়, এই রাজবাড়ির পূজোর সঙ্গে জড়িত হতে পেরে তারা গর্বিত।

আর পাঁচটা পূঁজো থেকে শুধু যে মায়ের প্রতিমার রুপ আলাদা তাই নয়, পূজোর আচার,নিয়মেও রয়েছে বৈশিষ্ট্য। এখানে পুজো হয় কালিকা পুরাণ মতে। মহালয়ার দিন রাজপরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে হয় তর্পণ ও মায়ের চক্ষুদান। হয় কালীপুজোও। দেশের সাত জায়গা থেকে সাতটি নদীর জল নিয়ে এসে মায়ের স্নান হয়। সপ্তমী এবং অস্টমীতে রাত ১২টায় হয় ‘অর্ধরাত্রি পুজো’। এই পুজোয় এক সময় নরবলির প্রথা ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। তবে নিয়ম রক্ষা করতে চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি পুতুল ও পায়রা বলি দেওয়া হয় অর্ধরাত্রি পুজোয়। অষ্টমীতে হয় কুমারীপুজো, যা দেখতে ভিড় উপচে পড়ে। নবমীতে সকলের মঙ্গল কামনায় হয় যজ্ঞ ও পাঁঠা বলি।

এই পুজোর আরও একটা বিশেষত্ব হল আমিষ ভোগ। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত দেবীর ভোগে থাকে পোলাও, ফ্রায়েড রাইস সহ কাতলা, ইলিশ, চিতল, পাবদা সহ বিভিন্ন প্রকারের মাছের ব্যঞ্জন। থাকে বলি দেওয়া পাঁঠার মাংস।

জলপাইগুড়ির মানুষ রাজবাড়ির পুজো উপভোগ করার জন্য সারা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। পুজোর কটাদিন সকলের জন্য অবারিত দ্বার রাজবাড়িতে। রাজবাড়ি চত্বরে যেন মেলা বসে যায়। প্রচুর মানুষের যেমন জমায়েত হয়, তেমনি দোকানপসরা নিয়ে হাজির হন ব্যবসায়ীরা। আড্ডা,নাচে,গানে মুখরিত হয়ে ওঠে রাজবাড়ি মন্দির প্রাঙ্গন। অস্টমীর দিন ভোগের প্রসাদ নেওয়ার জন্য ভিড় উপচে পড়ে। বিজয়াদশমীতে চলে মিষ্টিমুখ ও বাড়ির বধুদের সিঁদুরখেলা। সেই সিঁদুরখেলায় অংশ নেন শহরের অগণিত মানুষ। সিঁদুরখেলা শেষে হতেই, বেজে ওঠে বিষাদের সুর। তবে মা যেহেতু রাজবাড়িতে নিত্যপূজিতা, তাই প্রথা অনুযায়ী এখানে মা দুর্গার বিসর্জন হয় না। বিসর্জনের বদলে হয় “নিরঞ্জন”। রাজবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে অসংখ্য মানুষ মায়ের প্রতিমা-সহ রথ টেনে নিয়ে যায় রাজবাড়ির দিঘি পর্যন্ত। অজস্র ঢাকের তালে উদ্বেল হয়ে ওঠে আট থেকে আশি। রাজবাড়ি দিঘীতেই হয় প্রতিমা নিরঞ্জন । নিরঞ্জনের পর রাজবাড়ি দীঘির থেকে নেওয়া শান্তির জল ছড়িয়ে দেওয়া হয় মানুষের মধ্যে। মুখে হাসির সঙ্গে বিষাদের ছায়া নিয়ে ফিরে যান সকলে। হটাৎ করেই যেনো শুনশান হয়ে যায় রাজবাড়ি। আবার অপেক্ষা একটা বছরের।
বাইট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *